জনসংখ্যা সংকট মোকাবিলায় জাপানের নতুন অভিবাসন নীতি

জনসংখ্যা সংকট মোকাবিলায় জাপানের নতুন অভিবাসন নীতি

জাপান বর্তমানে এক গভীর জনসংখ্যা সংকটের মুখোমুখি, যেখানে জন্মহার হ্রাস এবং দ্রুত বার্ধক্য জাপানি সমাজের প্রতিটি স্তরে প্রভাব ফেলছে। এই চ্যালেঞ্জ মোকাবিলায় দেশটি অভিবাসন নীতিতে অভূতপূর্ব পরিবর্তন আনছে। একসময় বিদেশি জনসংখ্যাকে নিরুৎসাহিত করা জাপান এখন বিদেশি শ্রমিক এবং শিক্ষার্থীদের আকৃষ্ট করতে চাইছে।

জাপানের জনসংখ্যা সংকট: এক ভয়াবহ বাস্তবতা

২০০৮ সালে ১২৮ মিলিয়ন জনসংখ্যার শিখরে পৌঁছানোর পর থেকে জাপানের জনসংখ্যা দ্রুত হ্রাস পাচ্ছে। ২০২৩ থেকে ২০৫০ সালের মধ্যে জাপানের কর্মজীবী ​​জনসংখ্যা ১৯ মিলিয়ন কমে যাবে বলে আশঙ্কা করা হচ্ছে। জনসংখ্যা হ্রাস এবং বার্ধক্য উভয়ই জাপানের শ্রমবাজারে তীব্র ঘাটতি তৈরি করেছে এবং সামাজিক সুরক্ষার ব্যয় বাড়িয়েছে।

জাপানি নারীরা উচ্চ childcare খরচ, দীর্ঘ কর্মঘণ্টা এবং মায়েদের কর্মক্ষেত্রে ফিরে আসার ক্ষেত্রে সামাজিক কুসংস্কারের কারণে সন্তান ধারণে নিরুৎসাহিত হচ্ছেন। জাপানের বর্তমান উর্বরতার হার ১.৩-এ নেমে এসেছে, যা একটি স্থিতিশীল জনসংখ্যা বজায় রাখার জন্য প্রয়োজনীয় ২.১-এর অনেক নিচে। সরকার ‘বেবি বোনাস’ চালু করে জন্মকে উৎসাহিত করার চেষ্টা করলেও, তা পর্যাপ্ত নয়।

অভিবাসন নীতির দীর্ঘ ইতিহাস ও পরিবর্তন

ঐতিহাসিকভাবে, জাপান অভিবাসনকে উৎসাহিত করেনি। ১৯৫২ সালের ইমিগ্রেশন কন্ট্রোল অ্যান্ড রিফিউজি অ্যাক্টের মাধ্যমে কঠোর অভিবাসন নীতি প্রয়োগ করা হয়েছিল। ১৯৯০-এর দশকে ‘টেকনিক্যাল ইন্টার্ন ট্রেনিং প্রোগ্রাম’ (TITP) চালু হলেও, এটি প্রায়শই বিদেশি শ্রমিকদের জন্য শোষণমূলক ব্যবস্থায় পরিণত হয়েছিল। তাদের ন্যূনতম মজুরির নিচে অর্থ প্রদান করা হতো এবং অনিরাপদ পরিস্থিতিতে কাজ করানো হতো। বিদেশি শ্রমিকরা সামাজিক সুবিধা থেকেও বঞ্চিত ছিল এবং ২০০৮ সালের মন্দার পর ‘পে টু লিভ’ উদ্যোগের মাধ্যমে তাদের দেশ ছাড়তে উৎসাহিত করা হয়।

তবে, জনসংখ্যা সংকটের গভীরতা উপলব্ধি করে জাপান তার অভিবাসন নীতিতে আমূল পরিবর্তন এনেছে। এখন দেশটি বিদেশি কর্মী নিয়োগ ও ধরে রাখার ওপর জোর দিচ্ছে। এর মধ্যে রয়েছে:

  • স্বল্পমেয়াদী ভিসার সংখ্যা বৃদ্ধি
  • সর্বোচ্চ বসবাসের সময়কাল ৩ থেকে ৫ বছর পর্যন্ত বৃদ্ধি
  • বিদেশি শিক্ষার্থীদের আকর্ষণ যারা প্রায়শই জাপানে স্নাতক হওয়ার পরেও কাজ করে থাকেন। ২০৩৩ সালের মধ্যে ৪,০০,০০০ বিদেশি শিক্ষার্থী আনার লক্ষ্যমাত্রা রয়েছে।
  • স্পেসিফাইড স্কিল্ড ওয়ার্কার (SSW) এবং হাই স্কিল্ড ফরেন প্রফেশনালস (HSFP) প্রোগ্রামের মাধ্যমে নির্দিষ্ট শ্রম ঘাটতি পূরণ করা। SSW প্রোগ্রাম মধ্য-দক্ষ শ্রমিকদের জন্য এবং HSFP প্রোগ্রাম বিজ্ঞানী, গবেষক, ব্যবসায়ী এবং প্রকৌশলীদের জন্য।
  • TITP বাতিল করে নতুন ‘নিউ স্কিল ডেভেলপমেন্ট প্রোগ্রাম ফর ফরেন ওয়ার্কার্স’ (ইকুসেই শুরো) চালু করা, যা কর্মীদের কর্মস্থল পরিবর্তনের অনুমতি দেবে এবং দীর্ঘমেয়াদী বসবাসের পথ সুগম করবে।

এই সংস্কারগুলির ফলে জাপানে বিদেশি নাগরিকদের সংখ্যা উল্লেখযোগ্যভাবে বেড়েছে। ২০২৩ সালে এই সংখ্যা তিন মিলিয়নে পৌঁছেছে, যা জাপানের ইতিহাসে সর্বোচ্চ।

জনসচেতনতা এবং সংহতির চ্যালেঞ্জ

জাপান প্রায়শই জাতিগতভাবে সমজাতীয় হিসাবে পরিচিত হলেও, সাম্প্রতিক অভিবাসন বৃদ্ধির প্রতি জনগণের কাছ থেকে তেমন বিরোধিতা আসেনি। বেশিরভাগ জাপানি জনগণ অভিবাসন সংস্কারকে সমর্থন করে এবং এর উদ্দেশ্য বোঝে। ২০১৮ সালের একটি সমীক্ষায় দেখা গেছে, জাপানিদের ৫৮ শতাংশ একই সংখ্যক বা আরও বেশি অভিবাসীর পক্ষে।

তবে, জাপানের নীতিগুলি নতুনদের জাপানি অর্থনীতি এবং সমাজে সংহত হওয়ার জন্য পর্যাপ্ত সহায়তা প্রদান করে না। অভিবাসীরা ন্যূনতম ভাষা সহায়তা, শিক্ষায় অ্যাক্সেস এবং জাপানি সংস্কৃতি বোঝার জন্য সহায়ক সংস্থান পান না। জাপানে কোনো বৈষম্যবিরোধী আইন বা বিচারিক সংস্থা নেই, যা অভিবাসীদের জন্য বিচার চাওয়া কঠিন করে তোলে। এছাড়া, কঠোর নাগরিকত্বের নিয়মাবলী এবং জাপানি কর্মসংস্কৃতির কিছু বৈশিষ্ট্য, যেমন দীর্ঘ কর্মঘণ্টা এবং জ্যেষ্ঠতাকে অগ্রাধিকার দেওয়া, অভিবাসীদের জন্য চ্যালেঞ্জ তৈরি করে। অনেক বিদেশি শ্রমিক জাপানি কর্মীদের চেয়ে কম আয় করেন, যা ‘নেতিবাচক আত্মীকরণ’ (negative assimilation) নামে পরিচিত।

অভিবাসীদের জন্য ভাষা প্রোগ্রাম, বৈষম্য প্রতিরোধে সহায়তা, এবং চাকরির পরিবর্তনের সুযোগ প্রদান করা ‘ইতিবাচক আত্মীকরণ’ (positive assimilation) এর জন্য অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ।

জাপানি সরকার এবং জনগণ অভিবাসীদের বিরুদ্ধে না হলেও, জাপান তাদের আরও ভালো সহায়তা প্রদান করতে পারে। অভিবাসীদের জাপানি সমাজ এবং অর্থনীতিতে সংহত হতে সহায়তা করা কেবল নিয়োগের জন্যই নয়, বরং অভিবাসীদের কল্যাণ এবং অর্থনৈতিক নিরাপত্তার জন্যও অপরিহার্য। এই প্রচেষ্টাগুলিই জাপানের জনসংখ্যা সংকট এবং ফলস্বরূপ শ্রম ঘাটতি সমাধানে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করবে।

Free Consultation

Please enable JavaScript in your browser to complete this form.