এতদিন ধরে যারা মনেপ্রাণে অস্ট্রেলিয়ায় উচ্চশিক্ষার জন্য যেতে চেয়েও ভিসা রিজেকশনের আশঙ্কায় বা কাগজপত্র জমা দেয়া নিয়ে জটিলতায় ছিলেন, তাদের জন্যই আজকের পোস্ট।
নিশ্চয়ই শুনেছেন, বাংলাদেশ সম্প্রতি অস্ট্রেলিয়ার স্টুডেন্ট ভিসা সিস্টেমে অ্যাসেসমেন্ট লেভেল ১ এ উঠে এসেছে। কিন্তু আপনি হয়তো এখনো জানেন না কী এই অ্যাসেসমেন্ট লেভেল বা কীভাবে নির্ধারিত হয় কোন দেশ কোন লেভেলে যাবে। আর বাংলাদেশ লেভেল ১ এ ওঠায় আপনারই বা কী সুবিধা হবে?
আজকে আমরা জানব অস্ট্রেলিয়ার স্টুডেন্ট ভিসা সিস্টেমে অ্যাসেসমেন্ট লেভেল কী, এটি কীভাবে কাজ করে, কোন লেভেলের ক্ষেত্রে ভিসা রিকয়ারমেন্টস কেমন এবং কীভাবে আপনি বাংলাদেশের লেভেল ১ এ উন্নীত হওয়াকে পুরোপুরি কাজে লাগাতে পারেন। আসুন শুরু করা যাক।
অস্ট্রেলিয়ার অ্যাসেসমেন্ট লেভেল কীভাবে কাজ করে?
CRICOS বা কমনওয়েলথ এডুকেশন প্রোভাইডার ফর ওভারসীজ স্টুডেন্টস এ নিবন্ধিত সব প্রতিষ্ঠানকে অস্ট্রেলিয়ার ডিপার্টমেন্ট অব হোম অ্যাফেয়ারস একটি করে এভিডেন্স লেভেল বা অ্যাসেসমেন্ট লেভেল প্রদান করে। একই সাথে বিভিন্ন দেশকেও একটি করে লেভেল প্রদান করা হয়। সাধারণত এডুকেশন প্রোভাইডার এবং দেশগুলোকে তিনটি লেভেলে ভাগ করা হয়। এগুলো হল:
- লেভেল ১ = লো রিস্ক বা নিম্ন ঝুঁকি। এদের ক্ষেত্রে সাধারণত কম ডকুমেন্টস প্রয়োজন হয়।
- লেভেল ২ = মডারেট রিস্ক বা মধ্যম ঝুঁকি। এদের ক্ষেত্রে লেভেল ১ এর চেয়ে বেশি ডকুমেন্টস প্রয়োজন হয়।
- লেভেল ৩ = হাই রিস্ক বা উচ্চ ঝুঁকি। এই লেভেলে অনেক বেশি ডকুমেন্টস লাগে এবং সেগুলো কড়াকড়িভাবে চেক করা হয়।
এসব লেভেল দেয়ার ক্ষেত্রে বেশ কিছু বিষয় বিবেচনা করা হয়। এর মধ্যে রয়েছে দেশ বা প্রোভাইডারের পূর্বের পারফরম্যান্স। যেসব দেশ বা প্রোভাইডারের ক্ষেত্রে ভিসা ক্যান্সেলেশন, রিফিউজাল ইত্যাদি বেশি হয়, তাদের অ্যাসেসমেন্ট লেভেল কমে যায়। এমনকি কেউ যদি ভিসার মেয়াদের অতিরিক্ত সময় থাকে, সেক্ষেত্রেও সেই দেশ বা প্রোভাইডারের অ্যাসেসমেন্ট লেভেল কমে যায়।
দেশ এবং প্রোভাইডারের অ্যাসেসমেন্ট লেভেলের কম্বিনেশন
যখন একজন স্টুডেন্ট ভিসার জন্য আবেদন করে, ডিপার্টমেন্ট অব হোম অ্যাফেয়ারস তার দেশ এবং প্রোভাইডার দুটোর লেভেলই বিবেচনায় নেয়। এক্ষেত্রে তিন ধরনের ঘটনা ঘটতে পারে।
লো রিস্ক দেশ (যেমন লেভেল ১) + লো রিস্ক প্রোভাইডার (যেমন লেভেল ১)
যেহেতু দেশ এবং প্রোভাইডার দুটিই লো রিস্ক, এক্ষেত্রে তেমন কোনো অতিরিক্ত ডকুমেন্টস প্রয়োজন হয় না। এ কারণে ভিসা প্রক্রিয়া অত্যন্ত সহজ এবং দ্রুত হয়ে থাকে।
লো রিস্ক দেশ/প্রোভাইডার (যেমন লেভেল ১) + হাই রিস্ক দেশ/প্রোভাইডার (যেমন লেভেল ৩)
দেশ বা প্রোভাইডার এর মধ্যে যেকোনো একটি যদি হাই রিস্ক হয়, তখন অস্ট্রেলিয়া ভিসার জন্য অতিরিক্ত ডকুমেন্টস চেয়ে থাকে। এক্ষেত্রে ইংলিশ টেস্টের রেজাল্ট, ব্যাংক স্টেটমেন্ট ইত্যাদি আবশ্যক হতে পারে।
হাই রিস্ক দেশ (যেমন লেভেল ৩) + হাই রিস্ক প্রোভাইডার (যেমন লেভেল ৩)
দেশ এবং প্রোভাইডার দুটিই হাই রিস্ক হলে ভিসা রিকয়ারমেন্টসের ব্যাপারে অনেক কড়াকড়ি আরোপ করা হয়। এক্ষেত্রে যেমন অতিরিক্ত ডকুমেন্টস দরকার হয়, তেমনি ভিসা আবেদন কঠোরভাবে যাচাই-বাছাই করা হয়ে থাকে। এমনকি এসব ক্ষেত্রে ভিসা পেতে দেরি বা ভিসা প্রত্যাখ্যানও করা হতে পারে।
কান্ট্রি অ্যাসেসমেন্ট লেভেল কেন এত গুরুত্বপূর্ণ?
বেশ কিছু কারণে এই অ্যাসেসমেন্ট লেভেল সিস্টেম গুরুত্বপূর্ণ। আসুন জেনে নেই কারণগুলো।
- লো রিস্ক দেশগুলোর আবেদনকারীরা সাধারণত ডকুমেন্ট সম্পর্কিত জটিলতা তেমন পোহাতে হয় না। এছাড়া তাদের ভিসা আবেদনও খুবই অল্প সময়ের মধ্যে প্রসেস করা হয়।
- এই লেভেল সিস্টেমের মাধ্যমে ভিসার শর্ত ভঙ্গকারী বা প্রতারকদের সহজে চিহ্নিত করে আসল স্টুডেন্টদের বেশি সুযোগ দেয়া সম্ভব হয়।
- সত্যিকারের যারা ছাত্র-ছাত্রী, তারা এই সিস্টেমের কারণে কোনোরকম ভোগান্তি ছাড়াই অস্ট্রেলিয়ায় উচ্চশিক্ষার স্বপ্ন পূরণ করতে পারে।
কীভাবে দেয়া হয় অ্যাসেসমেন্ট লেভেল?
ডিপার্টমেন্ট অব হোম অ্যাফেয়ারস কীভাবে কোনো দেশ বা প্রোভাইডারের অ্যাসেসমেন্ট লেভেল নির্ধারণ করে সে বিষয়ে তাদের ওয়েবসাইটে বিস্তারিত দেয়া আছে। এখানে আপনাদের জন্য বিষয়গুলো সহজ করে তুলে ধরা হল।
বেশ কিছু এভিডেন্স লেভেল ইন্ডিকেটর স্কোর এর গড় বের করে এই লেভেল নির্ধারণ করা হয়। এই লেভেল ইন্ডিকেটরগুলো হল:
- ভিসা ক্যান্সেলেশন: যদি প্রতারণা, অসত্য তথ্য বা ভিসার শর্ত ভঙ্গের কারণে ভিসা বাতিল হয়। এক্ষেত্রে ভিসার ৮২০২ এবং ৮১০৫ নম্বর শর্ত বিবেচনা করা হয়।
- ভিসা রিফিউজাল: যদি কোনো ভিসা আবেদন প্রতারণার কারণে প্রত্যাখ্যান করা হয়।
- ভিসার অতিরিক্ত সময় থাকা বা অবৈধ বসবাস: ভিসার মেয়াদ শেষ হবার পর ২৮ দিনের মধ্যে যদি ভিসা নবায়ন বা নতুন ভিসা না পাওয়া যায়।
- প্রটেকশন ভিসার আবেদন: স্টুডেন্ট ভিসায় অস্ট্রেলিয়াতে এসে কেউ যদি প্রটেকশন ভিসার জন্য আবেদন করে।
এই ইন্ডিকেটরগুলোর প্রতিটির আলাদা গুরুত্ব আছে। কোনটির গুরুত্ব কতটুকু তা নিচে দেয়া হল:
- ভিসা ক্যান্সেলেশনের হার – ২৫% গুরুত্ব
- প্রতারণার কারণে ভিসা প্রত্যাখ্যানের হার – ৪০% গুরুত্ব
- প্রতারণা বাদে অন্যান্য কারণে ভিসা প্রত্যাখ্যানের হার – ১০% গুরুত্ব
- স্টুডেন্ট ভিসাধারী হয়ে অবৈধভাবে বসবাসের হার – ১৫% গুরুত্ব
- প্রটেকশন ভিসা আবেদনের হার – ১০% গুরুত্ব
এই ইন্ডিকেটরগুলোর গড় ইনডেক্স অনুযায়ী অ্যাসেসমেন্ট লেভেল নির্ধারিত হয়।
- গড় ইনডেক্স < ১.০ = অ্যাসেসমেন্ট লেভেল ১
- গড় ইনডেক্স ১.০ ≤ ২.৭ = অ্যাসেসমেন্ট লেভেল ২
- গড় ইনডেক্স > ২.৭ = অ্যাসেসমেন্ট লেভেল ৩
কোন লেভেলে কী ডকুমেন্ট দরকার হয়?
দেশ এবং প্রোভাইডারের অ্যাসেসমেন্ট লেভেল এর উপর ভিত্তি করে প্রতিটি আবেদনকারীর ক্ষেত্রে ভিন্ন ভিন্ন ডকুমেন্ট প্রয়োজন হতে পারে। এগুলোর মধ্যে রয়েছে:
- আর্থিক সক্ষমতার প্রমাণ: আবেদনকারীদের অবশ্যই অস্ট্রেলিয়ার বসবাসের পুরো মেয়াদে নিজের খরচ চালানোর জন্য পর্যাপ্ত অর্থ থাকতে হবে।
- ইংরেজি ভাষার দক্ষতার প্রমাণ: স্টুডেন্ট ভিসা পাবার জন্য আবেদনকারীকে অবশ্যই ইংরেজি ভাষায় দক্ষতার প্রমাণ হিসেবে টেস্ট স্কোর প্রদর্শন করতে হবে।
- এনরোলমেন্টের প্রমাণ: আবেদনকারী যে ইতোমধ্যে অনুমোদিত কোনো প্রতিষ্ঠানের কাছ থেকে কনফার্মেশন অব এনরোলমেন্ট পেয়েছেন সেই প্রমাণ দাখিল করতে হবে।
আপনি নিজেই ডকুমেন্ট চেকলিস্ট টুল ব্যবহার করে প্রয়োজনীয় ডকুমেন্ট সম্পর্কে জানতে পারেন। যদি বুঝতে অসুবিধা হয়, তাহলে আপনি আমাদের দক্ষ ও অভিক্ষ স্টুডেন্ট কাউন্সেলরদের সাহায্যও নিতে পারবেন।
স্টুডেন্ট হিসেবে আপনার করণীয় কী?
যদি আপনি আগামীতে অস্ট্রেলিয়ায় পড়তে যেতে চান, তাহলে এই লেভেল আপগ্রেডের কারণে আপনার আবেদন প্রক্রিয়া আগের চেয়ে অনেক সহজ হয়ে গেল। এখন আপনার করণীয় হবে অস্ট্রেলিয়ার যেকোনো লেভেল ১ প্রোভাইডারকে বেছে নেয়া। তাহলে আপনার ভিসা প্রক্রিয়া খুবই দ্রুত এবং সহজে সম্পন্ন হবে।
সেই সাথে আপনাকে সচেতন থাকতে হবে যেন আপনি এই লেভেল অনুযায়ী যথাযথ ডকুমেন্ট যেন সাবমিট করতে পারেন। এক্ষেত্রে যেকোনো প্রশ্ন থাকলে বা লেভেল ১ প্রোভাইডার খুঁজে পেতে সাহায্য দরকার হলে আমাদের জানাতে পারেন।
অস্ট্রেলিয়ায় আপনার উচ্চশিক্ষার স্বপ্ন পূরণ হোক।